1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মে দিবসে বাংলাদেশের শ্রমিকদের আক্ষেপ

সমীর কুমার দে ঢাকা
১ মে ২০২৪

বাংলাদেশে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কত? প্রতিবেশী দেশগুলোর শ্রমিকদের তুলনায় তা কম, নাকি বেশি?

https://p.dw.com/p/4fNwM
মে দিবসে ঢাকায় প্লেকার্ড হাতে স্লোগানরত কয়েকজন নারী শ্রমিক
মে দিবসে অধিকার আদায়ের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের কারখানা মালিকেরা প্রায়ই বলেন, শ্রমিকদের মজুরি আর বাড়ানো হলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এমন কথা কেন বলেন তারা? ?

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি নাজমা আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মালিকরা সব সময় শ্রমিক ঠকানোর চেষ্টা করেন। তাদের মূল সমস্যাটা হলো, বায়ারদের কাছ থেকে প্রতিযোগিতা করে তারা কম দামে কাজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কম দামে কাজ নেওয়ার কারণে শ্রমিকদের ঠকিয়ে সেটা পূরণের চেষ্টা তাদের। ভিয়েতনামে মালিকরা যে কাজ ১০ ডলারের নীচে করে না, বাংলাদেশের মালিকরা সেই কাজ ৮ ডলারে করে। আমাদের মালিকদের বক্তব্য হলো, কম মজুরি দেবো, বেশি কর্মসংস্থান করবো। অর্থাৎ, একটা সংসারে যদি ৪ জন থাকেন, তাহলে তাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। গত নভেম্বরে বেতন বাড়ানোর পরও যেটা হয়েছে, সেটা দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। ফলে আমরা এখন ন্যূনতম মজুরির বদলে লিভিং ওয়েজের কথা বলছি।”

যে মজুরি দেওয়া হয় তা যৌক্তিক না: সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ

কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর গত নভেম্বরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি ডলার সমান যদি ১১১ টাকা ধরা হয়, তাহলে মার্কিন ডলারে মজুরি দাঁড়ায় ১১২ ডলারের বেশি। গত পহেলা ডিসেম্বর থেকে এটা কার্যকর হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের বিটুবি ফ্যাশন ইউনাইটেডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেতন বৃদ্ধির পরও বিশ্বের অন্যান্য পোশাক উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। কম্বোডিয়া তাদের পোশাক শ্রমিকদের মাসে ন্যূনতম ২০০ মার্কিন ডলার মজুরি দেয়। এরপরেই রয়েছে ভিয়েতনাম। তারা পোশাক শ্রমিকদের প্রতি মাসে ১৯২ ডলার ন্যূনতম মজুরি দিয়ে থাকে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসে ন্যূনতম ১৬৫ ডলার মজুরি দেয়। আর বিশ্বের শীর্ষ তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ চীন তাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রতি মাসে ন্যূনতম মজুরি দেয় ১৬১ ডলার। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু পাকিস্তান। সে দেশে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১১০ ডলার।

শ্রমিকদের এত কম বেতন দেওয়ার পরও কেন পোশাক কারখানার মালিকরা প্রায়ই বলেন শ্রমিকদের বেতন আর বাড়ানোর হলে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে? এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি ও হান্নান গ্রুপের চেয়ারম্যান এ বি এম শামসুদ্দীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা শ্রমিকদের বেশি বেতন দিতে না পারার দু'টি প্রধান কারণ। প্রথমত, আমরা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে আছি। কে কার চেয়ে কম দামে অর্ডার নিতে পারবো সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফলে কম দামে অর্ডার নিয়ে তো শ্রমিককে বেশি বেতন দিতে পারবো না। অথচ, দেখেন, ভিয়েতনামে কোনো গার্মেন্টস মালিক চাইলেই কম দামে অর্ডার নিতে পারেন না। সেখানে সরকারের একটা নিয়ন্ত্রণ আছে। আমাদের গার্মেন্টস মালিকদের তো কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আর দ্বিতীয়ত আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতা প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে কম। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, আমরা কেন তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নজর দিচ্ছি না? সে চেষ্টাও করেছি। কাজ হয় না। আমাদের একজন শ্রমিক যে পরিমান উৎপাদন করতে পারেন, ভিয়েতনামের একজন শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা এর চেয়ে অনেক বেশি। ফলে আমাদের শ্রমিকদের বেতন কম।”

রানা প্লাজা ধস নিয়ে তথ্যচিত্র- 'কংক্রিট কবর কারাগার'

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কে তৈরি পোশাক খাতে মোট শ্রমিক ৪০ লাখ। ভিয়েতনামে কাজ করে ২৫ লাখ শ্রমিক, ফিলিপাইন্সে কাজ করে সাড়ে ৫ লাখ শ্রমিক, কম্বোডিয়ায় ছয় লাখ শ্রমিক, ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করে ৪২ লাখ শ্রমিক, ভারতে কাজ করে চার কোটি ৫০ লাখ পোশাক শ্রমিক, চীনে শ্রমিক এক কোটি ৫০ লাখ। অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতে কাজ করছে ৩২ লাখ শ্রমিক। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম।

বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে গার্মেন্টসে কর্মপরিবেশ কিন্তু এখন ভালো হয়েছে। এটা সত্যি। ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষমতাও আছে। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকদের এখনও মালিকদের সঙ্গে বেতন নিয়ে দরকষাকষির অবস্থা তৈরি হয়নি। গত বছর তারা যে বেতন বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন করলো সেখানে ৪ জন শ্রমিক গুলিতে মারা গেলেন, ১৮ হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হলো। বাংলাদেশে কোনো সেক্টরেই বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি নির্ধারণ করা নেই। বাংলাদেশে শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয় এটা শোভন জীবন যাপনের জন্য কোনোভাবেই যৌক্তিক না।”

দুই দিন আগে ভারতের ইকোনমিক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত সরকার ‘ন্যূন্যতম মজুরি' তুলে লিভিং ওয়েজ আনার চিন্তা করছে। এর জন্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের সাহায্য চেয়েছে দিল্লি। এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে আইএলও কর্মকর্তাদের সঙ্গে। লিভিং ওয়েজ চালু হলে ভারতে এখন যত টাকা বেতন দেওয়া হয়, তার থেকে বেশি টাকা মিলবে। মানুষের মৌলিক চাহিদা, বাসস্থান, খাদ্য, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, বস্ত্রের মতো বিষয়গুলির ক্রয়ক্ষমতা যাতে তৈরি হয়, সেই সমপরিমাণ মজুরির ভাবনাকেই ‘লিভিং ওয়েজ বলা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন এই ভাবনাকে সমর্থন করে।

মালিকরা সব সময় শ্রমিক ঠকানোর চেষ্টা করেন: নাজমা আক্তার

বাংলাদেশেও কি লিভিং ওয়েজ চালু করা সম্ভব? আইএলওর ঢাকা অফিসের সাবেক আইন উপদেষ্টা ও শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট ড. উত্তম কুমার দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘লিভিং ওয়েজের যে কনসেপ্ট সেটা হলো, একজন শ্রমিক তার যোগ্যতা অনুযায়ী পরিবার নিয়ে জীবন ধারণের জন্য ন্যূন্যতম যে অর্থ সেটা। বাংলাদেশের শ্রম আইনে ন্যূন্যতম মজুরির বিধান আছে। আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা লিভিং ওয়েজের জন্য প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা সরকারগুলোকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে। এটা করার জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে যারা শিল্পের মালিক তাদের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। আমাদের সংবিধান এটাকে সমর্থন করে। আমাদের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থার কথা বলা আছে।”

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনে মালিকদের শাস্তি বাড়ছে। জরিমানা ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মঙ্গলবার সচিবালয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর এ কথা বলেন মন্ত্রী। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘‘কারখানার মালিকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, তাদের বিচার হচ্ছে। শ্রমিক অধিকার যারা লঙ্ঘন করে, তাদের সাজা নিয়ে আইনে একটি ধারা আছে। সেখানে ৫ হাজার টাকা সাজা ছিল, এখন (আগের সংশোধনীতে) সেটিকে ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। মালিক-শ্রমিক ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলাপ করে এখন হয়তো বা ২৫ হাজার টাকা করা হবে।”

বাংলাদেশে শ্রমিকদের জন্য সব সেক্টরে ন্যূন্যতম মজুরি আগে নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘গার্মেন্টসে তো তা-ও ন্যূন্যতম একটা মজুরি নির্ধারণ করা আছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করা নেই। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৪৩টি সেক্টরে ন্যূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সেক্টরে ন্যূন্যতম মজুরির কোনো রিভিউ হয় না। ফলে শ্রমিকরা সব সময় বঞ্চিত হচ্ছেন। সব সেক্টরে যদি ন্যূন্যতম মজুরিটা যদি নির্ধারণ করা যায় তাহলেও পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। এক্ষেত্রে সরকার যেটা করতে পারে, সেটা হলো, সরকার ঘোষণা করবে যারা ন্যূন্যতম মজুরি বাস্তবায়ন করবে তাদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হবে। যারা করবে না এটা পাবে না। আসলে এ বিষয়ে সরকারকেই আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই পরিস্থিতি বদলাবে।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান